অঙ্কিতের ফোনে বারবার কল ড্রপ হচ্ছিল। বাঁকুড়ার বাসিন্দা অঙ্কিত ভেবেছিলেন এটি হয়তো নেটওয়ার্কের সমস্যা। এরপর হঠাৎ একদিন তাঁর ফোনের সিম কাজ করা বন্ধ করে দেয়। অঙ্কিত প্রথমে এই বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। কিন্তু এর কয়েক দিনের মধ্যেই একটি জরুরি কাজে তাঁকে ব্যাঙ্কে যেতে হয়। ব্যাঙ্কে গিয়ে অঙ্কিত জানতে পারেন তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে সমস্ত টাকা অন্য কোনও অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়েছে। অঙ্কিত সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের কাছে যান। তদন্তে জানা যায় তাঁর সিম ক্লোন করা হয়েছে। প্রতারকরা তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার জন্যই সিম ক্লোন করেছিল।
এই গল্প শুধু অঙ্কিতের নয়। তাঁর মতো হাজার মানুষ এমন ঘটনার শিকার হন। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী লোকেরা প্রায়ই এই ধরনের ফাঁদে পড়ে থাকেন। তাঁরা বুঝতে পারেন না যে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। মোটামুটিভাবে বলতে গেলে এই ধরনের ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ প্রশ্ন উঠে আসে:
প্রথম প্রশ্ন, প্রতারকরা কীভাবে বুঝবে যে অঙ্কিতের মতো লোকেরা তাদের শিকার হতে পারে?
দ্বিতীয় প্রশ্ন, এই পুরো ঘটনা কীভাবে পরিচালিত হয়?
তৃতীয় প্রশ্ন, এই ধরনের ঘটনা কীভাবে এড়ানো যায়?
এই ধরনের প্রতারণার ক্ষেত্রে কোনও একজন ব্যক্তি যুক্ত থাকে না। জড়িত থাকে একটা গোটা গ্যাং। যারাই খুঁজে বের করে কে হবে তাদের শিকার। ভুয়ো কল সেন্টারগুলিও একই কাজ করছে। কেউ আপনাকে ফোনে ডিসকাউন্ট অফার দিয়ে প্রলুব্ধ করে এবং OTP শেয়ার করতে রাজি করায়। কেউ কেউ আপনাকে KYC-র উদ্দেশ্যে OTP শেয়ার করতে রাজি করায়। এর মধ্যে কিছু প্রতারক আপনার সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকা প্রোফাইল স্ক্যান করে আপনার সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করে। কেউ কেউ আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্য জানারও চেষ্টা করে। আপনার সম্পর্কে প্রাপ্ত সমস্ত তথ্য এক জায়গায় জমা করা হয়। এই ধরনের সমস্ত কার্যকলাপ আপনার নেপথ্যে চলে অথচ আপনি এটি সম্পর্কে সচেতনও নন।
আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বিভিন্ন উপায়ে হ্যাক হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, একটি গ্যাং আপনার জাল আধার কার্ড তৈরি করে এসব করতে পারে। এরপর তারা আপনার সিম হারানোর বিষয়ে পুলিশকে জানায়। টেলিকম অপারেটর থেকে আপনার নামে একটি নতুন সিম নিয়ে প্রতারণা করতে পারে তারা। আপনি যখন এই সবকিছু জানতে পারবেন ততক্ষণে আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খালি হয়ে গিয়েছে।
আরেকটি পদ্ধতি হল যে কেউ আপনাকে কল করে বলবে যে তিনি Paytm থেকে কথা বলছেন অথবা তিনি একজন ব্যাঙ্ক অফিসার অথবা তিনি RO ওয়াটার পিউরিফায়ার পরিষেবা সংস্থা থেকে কল করছেন। তিনি আপনাকে তাৎক্ষণিক কেওয়াইসি পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ করতে বলবেন। তিনি আপনাকে একটি লিঙ্ক পাঠাবেন। আপনাকে ক্লিক করতে বলা হবে তাতে। আপনি সেই লিঙ্কে ক্লিক করার সঙ্গে সঙ্গে প্রতারকরা আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে।
এই সাইবার জালিয়াতরা ফোনের মাধ্যমে প্রায়শই জানিয়ে থাকে যে আপনাকে তারা ইন্টারনেট কোম্পানি থেকে কল করছে। যদিও কখনও কখনও তারা বলে থাকে যে তারা টেলিকম অপারেটর থেকে বা আপনার বিমা কোম্পানি থেকে বা কখনও কখনও আপনার ব্যাঙ্ক থেকে কল করছে। কিন্তু তারা কীভাবে জানবে কোনটি আপনার ইন্টারনেট কোম্পানি? বা আপনি কোন RO ব্যবহার করছেন?
আসলে আপনার ডেটা লক্ষ লক্ষ লোকের মাধ্যমে দেখা হচ্ছে। কখনও কখনও এই ডেটা ডার্ক ওয়েবেও বিক্রি হয়। ডার্ক ওয়েব হল ইন্টারনেটের সেই অংশ যা সার্চ ইঞ্জিনে অ্যাক্সেসযোগ্য নয়। ডার্ক ওয়েব সব ধরনের অবৈধ কার্যকলাপের জন্য ব্যবহৃত হয়।
এমন পরিস্থিতিতে ভুয়ো কল সেন্টারগুলি এই ডেটা কেনে বা হ্যাকারদের মোতায়েন করে চুরি করে। এর পরে তারা আপনাকে কল করতে শুরু করে এবং অবশেষে তারা আপনাকে প্রতারণা করতে সক্ষম হয়। এই ধরনের ক্ষেত্রে, ভুয়ো কল সেন্টারগুলি বড় মেট্রো শহর থেকে বা ঝাড়খণ্ড, বাংলা এবং ওড়িশার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কাজ করে থাকে।
কীভাবে রক্ষা করা যায়—
সাইবার জালিয়াতি এড়াতে সতর্কতাই সবচেয়ে বড় অস্ত্র। পুলিশ এবং সাইবার বিশেষজ্ঞ উভয়ই আপনাকে আপনার ফোন লক রাখতে, সময়ে সময়ে ইমেল এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। নেট ব্যাঙ্কিং, ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদির বিশদ বিবরণ কখনই কারোর সঙ্গে শেয়ার করবেন না। আপনার পাসওয়ার্ড কখনওই ইমেলে রাখবেন না। লটারি, হলিডে প্যাকেজ, কেওয়াইসি ইত্যাদির মতো তাৎক্ষণিক কলের উপর নির্ভর করবেন না৷ এই ধরনের লোকেদের সঙ্গে কখনও কোনও আর্থিক তথ্য শেয়ার করবেন না৷ এমনই সাধারণ কয়েকটি সাবধানতা অবলম্বনে আপনি এই ধরনের প্রতারণার শিকার হওয়া এড়াতে পারেন।
পার্সোনাল ফাইনান্স বিষয়ের সর্বশেষ আপডেটের জন্য ডাউনলোড করুন Money9 App