হায়দরাবাদের নরসিমহা খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। বড় স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ মেলেনি। কিন্তু জানতেন ডেটা এন্ট্রির কাজ। তাঁর আশা ছিল, হায়দরাবাদের কোনও IT কোম্পানিতে একটা চাকরি জুটে যাবে।
চাকরিও পেয়ে গেলেন। একটি তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিতে ক্লায়েন্ট সার্ভিসের কাজ ছিল। মাসে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা আয় হত তাঁর। নরসিমহার বাবার গুন্টুরে কৃষিজ পণ্য বিক্রির ব্যবসা আছে। কিন্তু বাবার মতো ব্যবসায় যোগ দিতে চাইতেন না নরসিমহা। যে কারণে তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরির জন্য প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। এরপর সব ঠিকঠাক চলছিল।
কিন্তু কোভিড মহামারী তাঁর দুনিয়ে ওলটপালট করে দিল। করোনার কুনজর থেকে রক্ষা পেলেন না তিনি। তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিতে ওয়ার্ক ফ্রম হোম শুরু হল। দু’মাস পরে তাঁর চাকরি চলে গেল!
মাত্র তিন বছরের চাকরিজীবন। ফলে যৎসামান্যই সঞ্চয় করতে পেরেছিলেন। চাকরি চলে যাওয়ার পরে ওলা ক্যাব চালানো শুরু করলেন নরসিমহা। কিন্তু সেখানে খুব একটা সুবিধা করতে পারলেন না।
গ্রামে ফিরে গিয়ে পারিবারিক ব্যবসা করার কোনও ইচ্ছে ছিল না নরসিমহার কোনও ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু তিনি করবেনই বা কী!
কোভিডের পরে ভারতের চাকরির বাজার দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে একদল চাকরিপ্রার্থী সদ্য চাকরির বাজারে পা রেখেছেন। আর অন্যদলে আছেন তাঁরা যাঁদের চাকরি চলে গিয়েছে ও নতুন চাকরি খুঁজছেন। নরসিমহার মতো লোক এই দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়েন।
সরকারের ৩০ লক্ষ কোটি টাকার বেশির বাজেটে নরসিমহার মতো লোকজনের কী কোনও প্রাপ্তিযোগ আছে? নরসিমহার মতো লোক ই-শ্রম পোর্টালে নথিভুক্ত হওয়ার মতো অসংগঠিত শ্রমিক নন। নন তাঁরা স্বনির্ভর কর্মীও, যাঁদের নিজেদের কাজ আছে এবং যাঁরা ফের নতুনভাবে নিজেদের কাজ শুরুর চেষ্টায় আছেন। একমাত্র অন্য কোনও কোম্পানিতে চাকরি পেলেই তাঁদের দুর্দশা ঘুচতে পারে।
ভারতে শ্রম শক্তির একটা বড় অংশ আছে যাঁরা বাজেট থেকে সরাসরি কোনওভাবে লাভবান হন না। কোম্পানির জন্য বাজেটে করছাড় বা ইনসেনটিভ থাকে। ব্যাঙ্ক থেকে সস্তায় কর দেওয়ার কথা বলা হয়। এবং আশা করা হয় যে, কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করবে এবং তার ফলে নরসিমহার মতো ব্যক্তিদের কাজ মিলবে।
কোভিডের পরে বাজেটে সরকারের তরফে যে সমস্ত পদক্ষেপ করা হয়েছে তাতে সার্ভিস সেক্টরের খুব একটা উপকার হয়নি।
ভারতের GDP-র ৬০% পরিষেবা ক্ষেত্র থেকে আসে। এই ক্ষেত্রেই সর্বাধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ মেলে।
ভারতীয় অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পরিষেবা ক্ষেত্র বিকশিত হতে থাকে। যার ফলে কাজ পান অসংখ্যক মানুষ।
কোভিড মহামারির ধাক্কায় পরিষেবা ক্ষেত্র সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেখানে নরসিমহার মতো লোকজন কাজ করতেন।
সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি বা CMIE-র পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে হোটেল ও ট্যুরিজম ক্ষেত্রে ৫০ লক্ষ, শিক্ষা ক্ষেত্রে ৪০ লক্ষ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এই সমস্ত ক্ষেত্রকে পুনঃরায় দাঁড় করাতে গত বাজেট বিশেষ কোনও ভূমিকা নিতে পারেনি।
বার বার ফিরে আসা কোভিডের ধাক্কার জেরে বহু ব্যবসায় চিরতরে ঝাঁপ পড়ে গিয়েছে। কোভিডের পরে সরকার যে সামান্য পদক্ষেপ নিয়েছিল তাতে নরসিমহার মতো কর্মচারীরা PF থেকে লোন নেওয়ার ক্ষেত্রে ছাড় পেয়েছিলেন। তাঁর কোম্পানির অংশের PF কন্ট্রিবিউশন সরকার ভর্তুকি দিয়েছে। কিন্তু সবটাই প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য।
নরসিমহার মতো লোকজন যে সমস্ত কারখানায় কাজ করেন তাদের হাতে ৫-৬ মাসের বেশি ক্যাস ফ্লো থাকে না। যে কারণে লকডাইন শুরু হতেই তাদের ব্যবসা ধসে পড়ে। আর কোম্পানিগুলি তাদের কাজকর্ম গুটিয়ে নেয়।
ইউরোপ ও আমেরিকাতেও এই সমস্ত কোম্পানি কোভিডের জেরে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু সেখানে সরকার বেকার ব্যক্তিদের সরাসরি সহায়তা করেছিল। কোম্পানিগুলিকে ইনসেনটিভ দিয়ে কর্মীদের চাকরি রক্ষা করেছে। যাতে লোকের জীবিকায় প্রভাব না পড়ে।
পে চেক প্রোটেকশন, আন-এমপ্লয়মেন্ট বেনিফিটের মতো পদক্ষেপ সার্ভিস সেক্টরে বেকারত্ব হ্রাস নিয়ন্ত্রণ করতে কার্যকরি প্রমাণিত হয়েছে।
কিন্তু ভারতে এমন কিছুই হয়নি।
এটুকুই আশা….
নরসিমহার কয়েকজন আত্মীয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় থাকেন। তাঁদের থেকে জানতে পারেন, চাকরি বাঁচানোর জন্য সেই সমস্ত দেশের সরকার সরাসরি সহায়তা করেছে। আর যাঁরা চাকরি হারিয়েছিলেন সরকার তাঁদের ভাতা দিয়েছে।
নরসিমহা এত দিনে বুঝে গিয়েছেন, মন্দা কাটার আগে তাঁর চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আর একটা বড় সমস্যা হল, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরে তাঁকে হয়তো নতুন করে অনেক কিছু শিখতে হতে পারে। কারণ ততদিনে হয়তো প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে অনেক বদল চলে আসবে।
এবারের বাজেটে সরকারের থেকে কিছুদিনের জন্য কি কোনও সরাসরি সহায়তা পাওয়া যাবে? উত্তরের আশায় নরসিমহা।
পার্সোনাল ফাইনান্স বিষয়ের সর্বশেষ আপডেটের জন্য ডাউনলোড করুন Money9 App