বিজনৌরের কৃষক সুধীরের একমাত্র চাষবাস করেই সংসার চলে। নিজের ৭ বিঘা জমি আছে। আয় বাড়াতে আরও ১৪ বিঘা জমি লিজ নিয়েছেন। এই ২১ বিঘা জমিতে তিনি আখ চাষ করেন। চাষ শুরু করতে দেরি হওয়ায় এই বছর বিঘা প্রতি ফলন ২০ কুইন্টাল পর্যন্ত কমে গিয়েছে। বোঝার উপরে শাঁকের আটি হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি। বেড়েছে আনুসঙ্গিক খরচ। পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে সুধীর মাসে গড়ে ১০ হাজার টাকা আয় করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
সুধীরের পরিবারে মা, স্ত্রী এবং দুই সন্তান-সহ মোট ৫ জন সদস্য। তাঁর দুই সন্তান বাড়ি থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের একটি বেসরকারি স্কুলে পড়ে এবং রোজ স্কুলের বাসে যাতায়াত করে।
সুধীর আয় বাড়ানোর জন্য গোপালন শুরু করেছিলেন। দুধ বিক্রি করে আয় থেকে চলত ছেলেমেয়ের পড়াশোনা।
লকডাউনে চাষবাসে তেমন একটা ক্ষতি না হলেও দুধ বিক্রি কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আয়ে টান পড়ে। এই লোকসানের ধাক্কা তিনি এখনও সামলে উঠতে পারেননি।
বাচ্চাদের স্কুলের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আর অনলাইন ক্লাসের জন্য স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল না। দিনরাত মেহনত করার পরে অনেক কষ্ট করে সুধীর বছরে মাত্র ১ লক্ষ থেকে সোয়া এক লক্ষ টাকা বাঁচাতে পারেন।
সুধীর চার মাস অন্তর ২,০০০ করে কিষাণ সম্মান নিধির কিস্তির টাকা পান। অর্থাৎ অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মাসে গড়ে মাত্র ৫০০ টাকা আমদানি বেড়েছে। এখন মাসে ১০-১১ হাজার টাকা আয়ে সংসার চালানো বড় কঠিন কাজ।
ভারতে মোট কৃষকের ৯০ শতাংশ ২ একরের কম জমির মালিক। সুধীর তাঁদেরই একজন।
২০২০ সালের আর্থিক সমীক্ষা অনুসারে, দেশের প্রায় ৭০ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দেশে মাথাপিছু গড় চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে ১.০৮ একরে এসে দাঁড়িয়েছে।
কেবলমাত্র ৬ বিঘা জমি চাষ করে পরিবারের ভরণপোষণ আজ প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সুধীর পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে থাকেন। এখানে সেচের সুবন্দোবস্ত আছে। যার সুবাদে ত্রিফসলি জমির পরিমাণ বেশি। ওই এলাকার কৃষকদের অবস্থা যদি এত করুণ হয় বিহার, ঝাড়খণ্ড বা ওড়িশার কৃষকদের অবস্থা কী, তা অনুমান করা খুবএকটা কষ্টসাধ্য নয়।
প্রতি বছর বাজেটের সময় কৃষকদের নিয়ে সবার মাথাব্যথা বেড়ে যায়। গত চার বছরে কৃষিখাতে বাজেট কতটা বাড়ানো হয়েছে, সেই পরিসংখ্যানও সরকার দেখিয়ে দেবে।
ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে কৃষকদের থেকে রেকর্ড পরিমাণ ফসল কিনেছে সরকার। কিন্তু এতে কত সংখ্যক কৃষক লাভবান হয়েছেন, তা সবসময় বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
২০২০-২১ বর্ষে কৃষি ক্ষেত্রের জন্য মোট ১ লক্ষ ৪২ হাজার কোটি টাকার সংস্থান ছিল।
২০২১-২২ বর্ষে এই বাজেট বাড়িয়ে ১ লক্ষ ৪৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়।
২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে কৃষকদের জন্য সম্মান নিধি যোজনা চালু করে সরকার। যে কারণে ২০১৯-২০ সালের বাজেটে কৃষি ক্ষেত্রের জন্য বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছিল।
কৃষি ক্ষেত্রে নয়া প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার অনুদান দিয়ে থাকে। ২০১৫-১৬ বর্ষে এই খাতে ৬ হাজার কোটি টাকা বণ্টন করা হয়েছিল। ২০১৯-২০ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২১-২২ সালে এই খাতে বণ্টনের পরিমাণ বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৮ হাজার ৫১০ কোটি টাকা।
কৃষিকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রের উপরে ভর্তুকির সুবিধা কীভাবে পাওয়া যায়, তা সুধীরের মতো বহু কৃষকের কাছেই অজানা।
নিজেদের কৃষকদরদি প্রমাণে বাজেটে নানা ভারী ভারী পরিসংখ্যান তুলে ধরে সরকার। গত বাজেটে সরকার কৃষি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ১৬ লক্ষ ৫ হাজার কোটি টাকা স্থির করা হয়েছিল। তবে এটা বাজেটের অংশ নয়। তবুও ঢাকঢোল পিটিয়ে তার প্রচার করে! তার থেকেও বড় কথা হল, সরকারের হাজার আশ্বাস সত্ত্বেও সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে গিয়ে ছোট কৃষকদের জুতোর শুকতলা ক্ষয়ে যায়।
যদিও কিষাণ ক্রেডিট কার্ড বা KCC কোনওভাবে একবার হয়ে গেলে ঋণ পাওয়া অনেক সহজ হয়ে যায়।
দেশে আড়াই কোটি কৃষকের কাছে কিষাণ ক্রেডিট কার্ড আছে। আর এটি খুবই উপযোগী। KCC-র মাধ্যমে ঋণের অঙ্ক ১.৬ লক্ষ কোটি থেকে বেড়ে ২০১৯ সালের মার্চে দাঁড়িয়েছে ৭.০৯ লক্ষ কোটি টাকা।
নিজের ছেলেও তাঁর মতো চাষবাস করুক, তা চান না সুধীর। তবে পড়াশোনাই বা কীভাবে চলবে! সংসার চালাতে গিয়েই আয়ের সবটুকু টাকা খরচ হয়ে যায়। তার মধ্যে অনলাইনে পড়াশোনার খরচ কোথা থেকে আসবে।
প্রতি বছর দেশে রেকর্ড ফসল উৎপন্ন হলেও অধিকাংশ চাষির ভাগ্যের উন্নতি হয় না। আর কোভিডের কারণে বাইরের কাজও বাড়ন্ত।
সরকারে কাছে সুধীরের একটাই প্রার্থনা, তাঁদের জন্য এমন কোনও পদক্ষেপ করা হোক যাতে মাসে অন্তত ১৫ হাজার টাকা আয় হতে পারে। এজন্য হয় কৃষিকাজের খরচ লাঘব হোক, অথবা ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হোক।
পার্সোনাল ফাইনান্স বিষয়ের সর্বশেষ আপডেটের জন্য ডাউনলোড করুন Money9 App